গ্যাংটক ভ্রমণ এর অভিজ্ঞতা – ৪ রাত ৫ দিন
জাস্ট কিছুদিন আগেই সিকিম এর গ্যাংটক (gangtok tour) থেকে ঘুরে এলাম। আর সঙ্গে করে নিয়ে এলাম বেশ কিছু ভালো এক্সপেরিয়েন্স দেখে এলাম ছবির মত সুন্দর বরফে ঢাকা পাহাড়ি উপত্যকা, নদী, ও লেক । আমাদের এই গ্যাংটক ট্যুর টি ৪ রাত ৫ দিনেরছিল ।
আমরা শিয়ালদা থেকে দার্জিলিং মেলে করে সকাল সকাল পৌঁছে গেলাম নিউ জলপাইগুড়ি। আমাদের প্ল্যান ছিল সিকিম ট্যুরিজমের বাসে করে গ্যাংটক পৌঁছানোর। কিন্তু কিছু অসুবিধা হয়ে যাওয়ায় আমরা SNT বাস স্ট্যান্ড থেকে শেয়ার গাড়ি করে পৌছালাম দেউরালি কার স্ট্যান্ড এ ৭০০ টাকা করে ভাড়া নিল প্রতি জন।
গ্যাংটক ভ্রমণ এর অভিজ্ঞতা
প্রথম দিন
এরপর দেউরালি বাস স্ট্যান্ড থেকে আরেকটি ট্যাক্সি ধরতে হল গ্যাংটক ম্যাল বা আমাদের হোটেল ছিল টিবেট রোড এ সেখানে পৌঁছানোর জন্য। পৌঁছেতে বিকেল হয়ে গেল। তাই প্রথম দিন বিকেলটা আমরা গ্যাংটক ম্যাল ই কাটিয়ে দিলাম এবং এমজি মার্গ (MG marg) একটি দোকান থেকে ডিনার সেরে হোটেলে ফিরে এলাম।
দ্বিতীয় দিন
পরের দিন সকাল বেলা মানে দ্বিতীয় দিন সকালবেলা আমরা এমজি মার্গের পাশের ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে একটা গাড়ি ধরলাম গ্যাংটকের লোকাল সাইট সিন করার জন্য। ২০০০ টাকার বিনিময়ে আমরা দশটার স্পট ঘুরে দেখলাম।
হস্তশিল্প এম্পোরিয়াম গ্যাংটক – Handicraft Emporium Gangtok
এই এম্পোরিয়াম টি ১৯৫৭ সালে তৈরি হয়েছিল। স্থানীয় এবং গ্রামের কারিগরদের তৈরি সিকিমের ঐতিহ্যবাহী হস্তশিল্প, আসবাবপত্র, কার্পেট, কম্বল সহ খোদাই করা বিভিন্ন ধরনের আসবাবপত্র ইত্যাদি জিনিস আপনারা এখানে দেখতে এবং কিনতে পারবেন এটি সারা বছরই খোলা থাকে।
বাকথাং জলপ্রপাত – Bakthang Waterfall
বাকথাং জলপ্রপাত টি গ্যাংটকের উত্তর সিকিম হাইওয়েতে অবস্থিত একটি ছোট জলপ্রপাত। গ্যাংটক এলাকার প্রধান জলের উৎস রাতেচু থেকে এই জলপ্রপাতের উৎপত্তি হয়েছে এবং গ্যাংটকের লোকাল সাইট সিন করতে বেরিয়ে প্রত্যেকেই এই জলপ্রপাত টি দেখতে আসেন।
গনজাং মনাস্ট্রি গ্যাংটক – Gonjang Monastery Gangtok
গনজাং মনাস্ট্রি গ্যাংটকের বিখ্যাত মঠ গুলির মধ্যে অন্যতম। এই মনাস্ট্রি টি সমতল থেকে ৬ ০০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত, ১৯৮১ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই মঠ টিতে সন্ন্যাসী ছাত্রদের সন্ন্যাস শিক্ষার পাশাপাশি তিব্বতি ভাষা এবং ইংরেজি শেখানো হয়।
তাশি ভিউ পয়েন্ট – Tashi View Point
গ্যাংটকের যে সমস্ত ভিউ পয়েন্ট গুলো আছে তার মধ্যে তাশি ভিউ পয়েন্ট অন্যতম। এই ভিউ পয়েন্ট টি থেকে খুব ভালো সূর্যাস্তের দৃশ্য এবং সূর্যোদয়ের দৃশ্য দেখতে পাওয়া যায়। আকাশ পরিষ্কার থাকলে এখান থেকেও খুব ভালো কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিউ ও পাওয়া যায়। এর একেবারে ওপরে উঠে যেতে পারলে সেখান থেকে পাহাড়ের উপত্যকার দারুন সুন্দর প্যানারমিক ভিউ পাওয়া যায়।
লাসা ফলস বা বুলবুলে ফলস – Lhasa falls or Bulbullay falls
তাশি ভিউ পয়েন্ট এর একদম কাছে এই লাসা ওয়াটার ফল্সটি অবস্থিত এবং রাস্তার ধারেই পড়ে, গাড়ি থেকে নামলেই দেখতে পাবেন। পাহাড়ের জলধারা থেকে এই ছোট জলপ্রপাত টি তৈরি হয়েছে। পাহাড় এবং জলপ্রপাত মিলিয়ে এখানে খুব ভালো কিছু ছবি তুলে নেওয়া যেতে পারে তার সঙ্গে সঙ্গে আপনারা যদি চান তাহলে জিপ লাইনিং (zip lining) অ্যাক্টিভিটিও করতে পারেন।
গ্যাংটক প্ল্যান্ট কনজারভেটরি – Plant Conservatory in Gangtok
গ্যাংটক প্লান্ট কনসারভেটরি এমন একটি জায়গা যেখানে সিকিমে জন্মানো বিভিন্ন গাছপালা এখানে সংরক্ষণ করা হয় এবং কি কি গাছপালা পাহাড়ি অঞ্চলে জন্মায় সেই সমস্ত দেখাও যায়। এই কনজারভেটরের মধ্যে প্রায় ৪০০ টেরও বেশি প্রজাতির গাছপালা রয়েছে। প্লান্ট কনসারভেটরিটি সকাল ন’টা থেকে বিকেল চারটা পর্যন্ত খোলা থাকে। তাশি ভিউ পয়েন্ট থেকে বেরিয়ে হনুমান টক যাওয়ার পথেই এই প্লান কনজারভেটরিটি পড়বে।
অর্গানিক ভিউপয়েন্ট – Organic Viewpoint
অর্গানিক ভিউ পয়েন্ট জায়গাটিও খুব সুন্দর এখান থেকে দূরের পাহাড়ি উপত্যকা দেখা যায় তার সঙ্গে সঙ্গে আকাশ পরিষ্কার থাকলে কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিউ ও পাওয়া যায়। প্লান্ট কনজারভেটরি থেকে বেরিয়ে আরেকটু গাড়ি নিয়ে এগিয়ে গেলেই আপনারা অর্গানিক ভিউ পয়েন্ট এ পৌঁছে যাবেন।
গনেশ টক – Ganesh Tok, Gangtok Temple & View Point
গনেশ টক হলো গ্যাংটক এর পাহাড়ের মাথায় অবস্থিত খুব সুন্দর ভগবান গণেশ এর একটি মন্দির। এই মন্দির টি পাহাড়ের সমতলভূমি থেকে প্রায় ৭২০০ হাজার ফুট উচ্চতা অবস্থিত। গণেশ টক মন্দিরটি ১৯৫৩ সালে তৈরি করা হয়। মন্দির পৌছানোর জন্য বেশ কয়েকটি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে হবে।
গনেশ টকএর উপর থেকে গ্যাংটক এর বহু দূর অবধি দেখতে পাওয়া যায়, মন্দিরের পাশে একটা খুব সুন্দর বসার ব্যবস্থা করা আছে, এবং চারপাশে খোলা বারান্দা ও রয়েছে যেখান থেকে দারুণ একটা ভিউ পাওয়া যায়। এখানে একটা খুব ভালো সুভিনিওর শপ ও আছে যেখান থেকে কেনাকাটা করা যেতে পারে।
হনুমান টক – Hanuman Tok Temple Gangtok
গ্যাংটকের লোকাল sideseeing করতে বেরিয়ে যে কটি জায়গা দেখেছি তার মধ্যে হনুমান টক আমার সব থেকে ভালো লেগেছে। ৭২০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত এই ভগবান হনুমানের মন্দির গ্যাংটক শহর থেকে প্রায় এগারো কিলোমিটার দূরে অবস্থিত।
প্রত্যেক বছর প্রচুর ভক্ত এখানে আসেন। ভারতীয় সেনাবাহিনী এই মন্দির টির রক্ষণাবেক্ষণ করে। কথিত আছে হিমালয় থেকে লক্ষণের জন্য যখন ভগবান হনুমান লঙ্কায় সঞ্জীবনী নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন ভগবান হনুমান এই পাহাড়ে বিশ্রাম নিয়েছিলেন। এই মন্দির থেকে চারপাশের পাহাড়ি উপত্যকা এবং ভ্যালির চমৎকার দৃশ্য পাওয়া যায় এবং পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম পর্বত শৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘাও এখান থেকে দেখতে পাওয়া যায়।
গ্যাংটক রোপওয়ে – Gangtok Ropeway
গ্যাংটকের বেস্ট অ্যাডভেঞ্চারাস এক্টিভিটির র মধ্যে অন্যতম হলো গ্যাংটক রোপওয়ে রাইড, এটি টি ২০০৩ সালে শুরু হয়। গ্যাংটকের রোপওয়ে টি দেওরালি বাজারের কাছে অবস্থিত।
রোপওয়ে টি দেখতে বড় কেবিনের মতো সেখানে একসঙ্গে ম্যাক্সিমাম ২৪ জন লোক উঠতে পারে। রোপওয়ে থেকে পুরো গ্যাংটকের বাজারের চারপাশের দৃশ্য দেখতে চমৎকার লাগে। রাইড টি কমপ্লিট করতে ১৫ -২০ মিনিট মতো সময় লাগে।
এর পর বিকেল বেলায় আবার আমরা গ্যাংটক ম্যালে ফিরে এলাম তারপর গ্যাংটক ম্যালে কিছুটা সময় কাটিয়ে ডিনার সেরে আমরা হোটেল এ ফিরে এলাম।
তৃতীয় দিন
তৃতীয় দিন সকালবেলা আমরা চলে গেলাম নাথুলা পাস, ছাঙ্গু লেক এবং নিউ বাবা মন্দির দেখতে । এই দিন আমাদের গাড়ি ভাড়া নিয়েছিল সাত হাজার টাকা। আমরা এই গাড়িটি বুক করেছিলাম টিবেট রোডের কাছের ট্যাক্সি স্ট্যান্ড থেকে , ওনারাই আমাদের পারমিট এর ব্যবস্থা করে দেন।
নাথুলা পাস | Nathula Pass Indo-China Border
নাথুলা পাস সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৪৪৫০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। নাথুলা পাস এ সারা বছর ই বরফ পাবেন এবং নাথুলা পাস যাবার বেস্ট টাইম হচ্ছে মে টু মিড নভেম্বর পর্যন্ত তারপরে কিন্তু ওখানে হেভি স্নোফল শুরু হয়ে যায় তখন কিন্তু নাথুলা পাস বন্ধ করে দেওয়া হয়।
নাথুলা পাস যেহেতু Indo-China Border তাই নাথুলা পাস যাওয়ার জন্য আপনাকে অবশ্যই পারমিট করাতে হবে।
ছাঙ্গু লেক – Tsomgo Chho or changu lake
ছাঙ্গু লেক নাথুলা পাস যাওয়ার পথেই পড়বে। ছাঙ্গু লেকে সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১২ হাজার ৪০০ ফুট উচ্চতায় অবস্থিত। লেকটিকে বছরের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম দেখতে লাগে এবং শীতকালে এই লেকটি পুরোপুরি ভাবে জমে যায়।
এখানকার চার পাশের পাহাড়ের বরফ গলেই এই লেকটি তৈরি হয়েছে। ছাঙ্গু লেক বেড়াতে এলে এখানে একটি রোপওয়ে রাইড হয় এই রাইড টি অবশ্যই এনজয় করবেন খুব ভালো লাগবে। গ্যাংটক থেকে Changu lake এর দূরত্ব হচ্ছে ৩৮ কিলোমিটার মতো.
নিউ হরভাজন বাবা মন্দির – New Baba Harbhajan Singh Temple
বাবা হরভজন সিং মন্দির টি হল ভারতীয় সেনাবাহিনী একজন সৈনিক কে উৎসর্গ করে তৈরি করা হয়েছে। তিনি দেশের জন্য ২৬ বছর বয়সে তার জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।
ছাঙ্গু লেকের কাছে এই নতুন বাবা মন্দিরটি তৈরি করা হয়েছে আমরা নাথুলা পাস, ছাঙ্গু লেক এবং নতুন বাবা মন্দিরটি একদিনে দেখেছিলাম। এখানে বলে রাখি নভেম্বরের মিডিল থেকে ফেব্রুয়ারী মাস কিন্তু এই বাবা মন্দির বন্ধ করে দেওয়া হয় কারণ তখন এখানে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা এবং তুষারপাত হয়।
চতুর্থ দিন
চতুর্থ দিন আমরা ফাঁকা রেখেছিলাম শপিং ও পায়ে হেঁটে কিছু জায়গা ঘোরার জন্য।
নামগয়াল টিবেটোলজি – Namgyal Institute of Tibetology in Gangtok
এই ইনস্টিটিউট টি বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান যা তিব্বতি ভাষা ও তিব্বতি সংস্কৃতিকে নিয়ে গবেষণা করে। এই ইনস্টিটিউট ১৯৫৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। গ্যাংটক ম্যাল থেকে মাত্র ২ কিলোমিটারের মধ্যেই দেওরালি অঞ্চলে এই ইনস্টিটিউট অবস্থিত। এর র ভিতরে একটি জাদুঘর দুটি গ্রন্থাগার এবং একটি গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে।
ডু দ্রুল মনাস্ট্রি Do Drul Chorten Stupa, Gangtok
ডু দ্রুল মনাস্ট্রি টি নামগয়াল টিবেটোলজির কাছেই অবস্থিত। এই মনাস্ট্রি টি সিকিম গ্যাংটকের যে বৌদ্ধস্তূপ গুলি আছে তার মধ্যে সবচেয়ে বৃহত্তম। ১৯৪৫ সালে এই বৌদ্ধ স্তুপ টি তৈরি হয়। এখানে পৌঁছানোর জন্য দর্শনার্থীদের প্রায় ৫০০ মিটার খাড়াই পথ হেঁটে উঠতে হবে।
পঞ্চম দিন
পঞ্চম দিন আমরা সকালবেলা গ্যাংটক এর SNT বাসস্ট্যান্ড থেকে বাস ধরি শিলিগুড়ি র উদ্দেশ্যে। এই বাস গুলির র টিকেট যেহেতু আগের দিন বিকেল চারটে থেকে অনলাইন টিকিট বুকিং ওপেন হয়ে যায়, তাই বাসগুলি র সিট্ গুলিও খুব তাড়াতাড়ি ভরে যায়। তাই দিনের দিন বাস স্ট্যান্ড এ এসে টিকেট কাটতে হলে, বেশ কয়েক ঘন্টা পরের ই বাস পাবেন।
শিলিগুড়ি পৌঁছানোর আগে আমরা বেঙ্গল সাফারি তে নেমেছিলাম যেহেতু আমাদের কাছে অনেক টাইম ছিল তাই। আমরা বেঙ্গল সাফারি টাও ঘুরে দেখেছিলাম এনজয় করেছিলাম গাড়ি তে করে টাইগার সাফারি। এরপর শিলিগুড়িতে পৌঁছে হংকং মার্কেটে কিছুটা শপিং করে তারপর আবার দার্জিলিং মেইল ধরে শিয়ালদা বা কোলকাতা ফিরে এসেছিলাম।