আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস | মে দিবস
শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাসে “আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস” (International Labour Day) একটি স্মরণীয় অধ্যায়। হাজার হাজার শ্রমিকদের আপোষহীন সংগ্রামের কথা বলে শ্রমিক দিবস। আন্তর্জাতিক কর্মী দিবস বা শ্রমিক দিবস ১লা মে-তে পালিত হয়। এই কারণে দিনটি “মে দিবস” নামেও পরিচিত।
শ্রম সাফল্যের চাবিকাঠি। একটি দেশ গড়ে তোলার পিছনে থাকে সেই দেশের মানুষদের তথা শ্রমিকদের কঠিন পরিশ্রম। শ্রমিকগোষ্ঠীর কঠোর পরিশ্রম এবং কৃতিত্বগুলির উদযাপনের দিন হল শ্রমিক দিবস। এই দিনবিশ্বজুড়ে সমগ্র শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ব্রত নিয়েছিল।

আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস | মে দিবস
শ্রমিক দিবসের সূত্রপাত
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমদিকে শিল্পায়নের উত্থান ঘটে। এই শিল্পায়ন বৃদ্ধির পিছনে জড়িয়ে ছিল শ্রমিকদের অক্লান্ত পরিশ্রম। অথচ এই শ্রমিকদের, প্রতি পদক্ষেপে শোষিত ও অত্যাচারিত হতে হত শিল্পপতি বা মালিকপক্ষের হাতে। শ্রমিকরা দিনে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা কাজ করতেন, কিন্তু সপ্তাহের শেষে পারিশ্রমিক পেত যৎসামান্য।
শ্রমিকদের কাজ করার পরিবেশ যথেষ্ট অস্বাস্থ্যকর ছিল, তাই তাদের বিভিন্ন রোগ হত। ফলে মৃত্যু ছিল শ্রমিকদের জীবনের রোজকার ঘটনা। সেইসময় শ্রমিকদের কোনো সংগঠন ছিল না। ফলে একত্রিত হয়ে প্রতিবাদ করা বা মালিকপক্ষের কাছে শ্রমিকদের কথা পৌঁছানোর কোনো মাধ্যম ছিল না। এই অসময়েই সারা বিশ্বে শ্রমজীবী মানুষদের মধ্যে সমাজতন্ত্র বিশেষভাবে জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং আন্দোলনের একটি প্রেক্ষাপট তৈরি হয়।
১৮৮৬ সালের পয়লা মে শিকাগো শহরে হাজার হাজার শ্রমিক ধর্মঘট করেন। তাদের দাবি ছিল ন্যায্য মজুরি ও দৈনিক ৮ ঘণ্টা কাজের সময় নির্ধারন। শ্রমিকদের স্লোগান ছিল “আট ঘন্টার শ্রম, আট ঘন্টার ঘুম এবং আট ঘন্টার বিনোদন”। দীর্ঘদিনের কঠিন সংগ্রামের পর শেষে শ্রমিকদের জয় হয়। শ্রমিকদের এই সংগ্রাম এবং বলিদানকে স্মরণীয় করার দিন ই হল “শ্রমিক দিবস”।

পড়ুন :- ২৫ শে বৈশাখ | কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর জীবনী ও সৃষ্টিকর্ম
শ্রমিক দিবসের ইতিহাস
১৮০০ দশকের শেষদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিল্প বিপ্লব ঘটেছিল। আমেরিকান শ্রমিকরা একটি নূন্যতম জীবনধারণের জন্য সপ্তাহের সাতদিন ১২-১৫ ঘণ্টা করে কাজ করতেন। আমেরিকার কিছু রাজ্যে ৫-৬ বছরের শিশুরা দের ও মিল, কারখানা এবং খনিতে কঠোর পরিশ্রম করতে হতো।
শ্রমিকরা অতি দারিদ্রতা, অনিরাপদ এবং অস্বাস্থ্যকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতেন। তাই শ্রমিকরা এই খারাপ অবস্থা এবং বেতন বৃদ্ধির দাবিতে বিভিন্ন জায়গায় ধর্মঘট এবং সমাবেশ শুরু করেছিলেন।
১৮৮২ সালে ৫ই সেপ্টেম্বর দশ হাজার শ্রমিক কুচকাওয়াজ করে নিউইয়র্ক-এর সিটি হল থেকে ইউনিয়ন স্কোয়ারের দিকে যাত্রা করেছিলেন।
এরপর ১৮৮৬ সালের ১লা মে আমেরিকার শিকাগো শহরের হে মার্কেটে ধর্মঘট শুরু হয়। তেসরা এবং চৌঠা মে আন্দোলন চূড়ান্ত রূপ ধারণ করে। কোনো অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি পুলিশের উদ্দেশ্যে বোমা নিক্ষেপ করেন। ফলে পুলিশও পাল্টা গুলি চালায়। প্রায় ১০-১২ জন শ্রমিক ও পুলিশ নিহত হন।
১৮৮৯ সালে কংগ্রেসের প্রথম আন্তর্জাতিক অধিবেশন প্যারিস-এ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। রেমন্ড লাভিনে এই অধিবেশনে, ১৮৯০ সাল থেকে শ্রমিক দিবস পালনের প্রস্তাব দেন। ১৮৯১ সালে এই প্রস্তাব আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়।
১৮৯৪ সালে ১১ই মে শিকাগোর পুলম্যান প্যালেস কার সংস্থার শ্রমিকরা মজুরি হ্রাস এবং ইউনিয়ন প্রতিনিধিদের উপর গুলি চালানোর প্রতিবাদে ধর্মঘট করেন। ২৬শে জুন ইউজিন ভি ডেবস-এর নেতৃত্বে আমেরিকার শ্রমিক ইউনিয়ন দেশব্যাপী পুলম্যান কারের সমস্ত গাড়ি বয়কট করার আহবান জানিয়েছিল।
পুলম্যান ধর্মঘট ভাঙার জন্য ফেডারেল সরকার শিকাগোতে সেনা পাঠিয়েছিল। সেনাদের গুলিতে এক ডজনেরও বেশি শ্রমিক মারা গিয়েছিল।
আমেরিকান শ্রমিকদের সাথে সম্পর্ক পুনরুদ্ধারের প্রয়াসে কংগ্রেস একটি আইন পাশ করে। ফলে শ্রম দিবস আইনি ছুটিতে পরিণত হয়। ১৮৯৪ সালে ২৮শে জুন রাষ্ট্রপতি গ্রোভার ক্লিভল্যান্ড আইনটিতে স্বাক্ষর করেন। এরপর থেকে শ্রমিক দিবস উদযাপিত হয়ে চলেছে ।

পড়ুন :- ২১ শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস
শ্রমিক দিবসের গুরুত্ব
সারা বিশ্বের মেহনতি মানুষের সঙ্কল্প নেওয়ার দিন হল শ্রমিক দিবস। সামাজিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে শ্রেণীবিষম্যকে বিলুপ্ত করাই হল এর সংকল্প। পুঁজিবাদী দাসত্ব শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পাওয়ার কথা মনে করায় এই দিনটি ।
মে দিবস সমগ্র শ্রমিকশ্রেণীর চিন্তায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে। শ্রমিক দিবস সারা বিশ্বে মুক্তি আন্দোলন এবং শ্রমিক আন্দোলনের ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ। শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধতা, সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদের স্বরূপ হল বর্তমানের সভ্য সমাজ।
মূলত ১৮৮৬ সালের শ্রম আন্দোলনই জন্ম দেয় শ্রমিক দিবসের। তাই বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে শ্রমিক দিবসের গুরুত্ব ব্যাপকভাবে সমাদৃত।
পড়ুন :- জাতীয় শিশু দিবস । ভারত বাংলাদেশ ও অনন্য
শ্রমিক দিবসের তাৎপর্য
বিশ্ববাসীর কাছে শ্রমিক দিবস তাৎপর্যপূর্ণ ছুটির দিন হয়ে ওঠার কারণগুলি নিম্নলিখিত:
- শ্রমিকরা যখন সংগঠিত এবং সম্মিলিত উপায়ে কাজ করেতখন তারা শক্তিশালী হয়ে ওঠেন।
- শ্রমিক দিবস শ্রমিকদের একত্রিত করে। দিনটি ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করার ক্ষমতা স্মরণ করিয়ে দেয়।
- শ্রমিকরা প্রায়শই উপেক্ষিত বোধ করেন। এই দিনটির জন্য শ্রমিকরা সারা বছর ধরে কাজের জন্য সম্মানিত বোধ করতে পারেন।
- শ্রমিকরা তাদের অধিকার সম্পর্কে প্রচার এবং প্রয়োজনে আন্দোলন করতে শিখেছেন। এইভাবে তারা নিজেদের এবং তাদের পরিবারের জন্য ভালো জীবনযাপন তৈরি তে সক্ষম হন।
- শ্রমিকরা মূলত তাদের কাজ দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে শক্তি প্রদান করেন।
- সারা বিশ্বজুড়ে শ্রমিকদের সাধারণ সংগ্রাম এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে শ্রমিক দিবস তাদের একত্রিত করে।
- শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে পালিত এই দিনটিতে শ্রমিকরা প্রয়োজনীয় বিশ্রাম নিতে পারেন।
- শ্রমিক দিবস মানুষকে কাজে যোগদান এবং কঠোর পরিশ্রমের জন্য অনুপ্রাণিত করে।

পড়ুন :- ভারতের স্বাধীনতা দিবস উদযাপন | ১৫ আগস্টের ইতিহাস
বিশ্বজুড়ে শ্রমিক দিবস পালন
আমেরিকা মহাদেশ
আমেরিকায় সেপ্টেম্বরের প্রথম সোমবার শ্রমিক দিবস পালিত হয়। শ্রম দিবসের দিনে শিকাগোর ‘হে মার্কেটের’ আত্মত্যাগী শ্রমিকদের স্মৃতিতে আগুন জ্বালানো হয়। দেশের নাগরিকেরা প্যারেড, পিকনিক, বারবিকিউ পার্টি, আতশবাজির প্রদর্শন এবং জন সমাবেশের মাধ্যমে শ্রমিক দিবস পালন করেন।
অনেক আমেরিকানদের কাছে বিশেষ করে শিশু এবং তরুণ প্রাপ্ত বয়স্কদের জন্য এটি গ্রীষ্মের শেষ এবং ‘ব্যাক-টু-স্কুল’ মরসুমের সূচনা করে।
পিটার জে. ম্যাকগুয়ে
পিটার জে. ম্যাকগুয়ের নিউইয়র্ক-এর একজন কাঠমিস্ত্রী ছিলেন। তিনি ব্রাদারহুড অফ কারপেনটার্সের জেনারেল সেক্রেটারি ও ছিলেন। একই সাথে তিনি শ্রমিক সংগঠনের একজন নেতা ছিলেন।
ম্যাকগুয়ের ভেবেছিলেন আমেরিকান শ্রমিকদের নিজস্ব দিনে সম্মানিত করা উচিত। তাঁরএইচিন্তাধারা বাস্তবায়িত করার জন্য ম্যাকগুয়ের ১৮৮২ সালে নিউইয়র্ক-এর “সেন্ট্রাল লেবার ইউনিয়ন” বা কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনের কাছে আবেদন জানিয়েছিলেন। ইউনিয়ন-এরও এই চিন্তাধারা পছন্দ হয়। ফলে “সেন্ট্রাল লেবার ইউনিয়ন” শ্রমিক দিবস পালনের সম্মতি জানায়।
এই ঘটনার জন্য পিটার জে. ম্যাকগুয়ের শ্রমিক দিবসের প্রতিষ্ঠাতা বা জনক হিসাবে ইতিহাসে বিখ্যাত হন । ১৮৮৯ সালে “মারসিস্ট ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট কংগ্রেস”-এর প্যারিস অধিবেশনে ১লা মে শ্রমিক দিবস হিসাবে নির্বাচিত করা হয়।
কানাডা
১৮৯৪ সালে প্রধানমন্ত্রী জন স্পারাও ডেভিড থমসন সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সোমবার শ্রমিক দিবসের ঘোষণা করেন। এই দিনটিতে কানাডায় সরকারী ছুটি থাকে।
কানাডিয়ানরা প্রথম শ্রমিক দিবস পালন করেছিলেন কুচকাওয়াজের মাধ্যমে, এটি বের হয়েছিল দ্যা মার্স পার্ক থেকে সকাল ৯টায়। কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণকারীদের জন্য বিভিন্ন খেলা এবং পিকনিকের আয়োজন করা হয়েছিল।
বর্তমানে কিউবেক সিটি, টরেন্টো এবং ওটাবাতে কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠিত হয়। জনসমাগম, সাইকেল প্রতিযোগিতা, পা-দৌড়(ফুট রেস) এবং ল্যাক্রোস ম্যাচ-এর মাধ্যমে শ্রমিক দিবস পালন করা হয়ে থাকে।
আর্জেন্টিনা
আর্জেন্টিনায় ১৮৯০ সালে প্রথম শ্রমিক দিবস উদযাপন করা হয়েছিল। ১৯৩০ সালে পয়লা মে সর্বপ্রথম সরকারী ছুটি হিসাবে ঘোষণা করা হয়। তারপর থেকে শ্রমিক দিবস পালন হয়ে আসছে।
আর্জেন্টিনিয়রা শ্রমিক দিবসে বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা সভা, প্যারেড এবং রাস্তায় শোভাযাত্রার আয়োজন করে। বুয়েনাস এরিস-এর আভেনিদ দে মেয়ো এভিনিউ-এ বিশাল সংখ্যক মানুষ জমায়েত হন শ্রমিক দিবস উদযাপন উপভোগ করতে।
দেশের অনেক মানুষ তাদের বন্ধু এবং পরিবারের সাথে উদযাপন করে এই দিনটি। তারা কিছু প্রচলিত স্থানীয় খবর যেমন এমপানাডাস, লোক্রো, আসাদো ইত্যাদি খান।
বলিভিয়া
বলিভিয়ায় ১৯৮২ সালে গণতন্ত্র ফিরে আসে। তারপর থেকে বলিভিয়ার সকল শ্রমিক সংগঠন ১৯৮২ সালের ১লা মে তারিখটিকে শ্রমিক দিবস হিসাবে সসম্মানে পালন করে। মে দিবস বলিভিয়ায় একটি ছুটির দিন।
শ্রমিক দিবসে সাধারনত বলিভিয়ার রাষ্ট্রপতি শ্রমিকদের পক্ষে কিছু অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক পদক্ষেপের ঘোষণা করেন। দেশে প্রধানত শ্রমিক দিবস উপলক্ষে মেলার আয়োজন করা হয়। এছাড়া পদযাত্রা, কুচকাওয়াজ, সমাবেশের মাধ্যমেও শ্রমিক দিবস পালন করা হয়ে থাকে।
ব্রাজিল
ব্রাজিলে শ্রম দিবস পালিত হয় ১৮৯৫ সাল থেকে। ১৯২৪ সালের ২৬শে সেপ্টেম্বর ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি আর্থার দা সিলভা বার্নারডেস-এর আদেশে ১লা মে শ্রমিক দিবস ছুটির দিন হিসাবে ঘোষণা করা হয়। তিনি শ্রমজীবী শহিদদের স্মরণে এই দিনটি জাতীয় ছুটি হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
১৯৪০ সালে ১লা মে ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি গেটালিও ভারগাস শ্রমিকদের নূন্যতম মজুরি ৮৮০ রেইস (ব্রাজিলিয়ান মুদ্রা অর্থাৎ ভারতীয় মুদ্রায় প্রায় ১২,৩৩০ টাকা) নির্ধারন করেন।
১৯৪১ সালে ১লা মে শ্রমিকদের আইনি অধিকার সম্পর্কিত সমস্যা সমাধানের জন্য শ্রম আদালত তৈরি করা হয়েছিল।
বর্তমানে ব্রাজিলে প্যারেড, বক্তৃতা সভার মাধ্যমে শ্রমিকদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। ঐতিহ্যগতভাবে এই দিনটিতে ব্রাজিলিয়ানরা বারবিকিউ পার্টি, পিকনিক করে শ্রমিক দিবস উদযাপন করেন।
আফ্রিকা মহাদেশ, আলজিরিয়া
আফ্রিকার আলজিরিয়াতে বসবাসরত ফরাসি শ্রমিকদের জন্য একটি শ্রমিক সংগঠন ছিল। তাদের প্রভাবেই মূলত আলজিরিয়ায় শ্রম দিবস উদযাপন করা হয়।
১৯৬২ সাল থেকে ১লা মে আলজিরিয়াতে শ্রমিক দিবস পালন করা হয়। বর্তমানে আলজিরিয়ানরা তাদের পরিবার এবং বন্ধুদের সাথে এই দিনটি কাটান । কেউ কেউ শ্রমিক সংগঠনের বিভিন্ন অনুষ্ঠান, প্যারেড, মিছিলে অংশগ্রহণের মাধ্যমে শ্রমিক দিবস পালন করে থাকেন।
আলজিরিয়া ছাড়া দ্যা জাম্বিয়া, মালি, নামিবিয়া, জাম্বিয়া, জিম্বাবোয়েতে ১৯৬৩ সাল থেকে পয়লা মে শ্রমিক দিবস পালন করা হয়ে থাকে।

ইউরোপ মহাদেশ
মধ্যযুগে এবং আধুনিক ইউরোপে পয়লা মে বসন্তের প্রত্যাবর্তন উৎসব বিখ্যাত ছিল। পরে এই উৎসব শ্রম আন্দোলন এবং শ্রমিক দিবস দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়েছিল।
সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং তার পূর্বের দেশগুলিতে মে দিবস একটি গুরুত্বপূর্ণ ছুটিতে পরিণত হয়েছিল। মস্কোর রেড স্কোয়ার-এ শ্রমিকরা এবং কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা প্যারেড এবং জমায়েত করে শ্রমিক দিবস পালন করেছিলেন। এরপর ১৯৩৩ সালে ইউরোপে মে দিবস সরকারী ছুটি হিসাবে ঘোষণা করা হয়।
বর্তমানে ইউরোপিয়ানরা পিকনিক-এর মাধ্যমে মে দিবস পালন করে থাকে। কিউবা, চায়না, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়াতেও পয়লা মে মে দিবস বা শ্রমিক দিবস সরকারী ছুটির দিন হিসেবে পালিত হয়।
ভারতে শ্রমিক দিবস পালন
ভারতবর্ষে সর্বপ্রথম ১৯২৩ সালে হিন্দুস্তান শ্রমিক কিষান পার্টি দ্বারা মাদ্রাস-এ (বর্তমানে চেন্নাই) শ্রমিক দিবস পালিত হয়েছিল। ১৯২৩ সালে ১লা মে সর্বপ্রথম শ্রমিক দিবসের প্রতীক হিসেবে লাল পতাকা উত্তেলিত হয়েছিল।
কমরেড সিঙ্গারাভেলর (মালায়াপুরম সিঙ্গারাভেলু চেটটিয়ার) শ্রমিক দিবস উদযাপনের আয়োজক ছিলেন। সিঙ্গারাভেলর ছিলেন মাদ্রাস প্রেসিডেন্সির অন্যতম নেতা। তিনি পিছিয়ে পড়া শ্রেণীদের অধিকার নিয়ে লড়াই করেছিলেন।
প্রথম শ্রমিক দিবসে ত্রিপিলিকেন সমুদ্রসৈকত এবং মাদ্রাস হাই কোর্ট-এর বিপরীতে দুটি সভার আয়োজন করা হয়েছিল। এই সভায় সিঙ্গারাভেলর, মে দিবস বা শ্রমিক দিবসকে সরকারী ছুটি ঘোষণার প্রস্তাব পেশ করেন। ভারতবর্ষে আজও এই দিনটি শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে পালিত হয়।
বর্তমানে ভারতের বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ বিভিন্ন জনসভায় শ্রমিকদের আত্মত্যাগের বিষয়ে বক্তৃতা দেন। জনসভা, আলোচনাসভা, শোভাযাত্রা, মিছিল ইত্যাদির মাধ্যমে শ্রমিক দিবস পালিত হয়।
বাংলাদেশে শ্রমিক দিবস পালন
বাংলাদেশে শ্রমিক দিবস পয়লা মে-তে পালন করা হয়। এই দিনটিতে বাংলাদেশে সরকারী ছুটি থাকে।
শ্রমিক দিবসে প্রধানমন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিগণ শ্রমিকদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেন। শিকাগোর শ্রম আন্দোলনের স্মৃতিচারণের জন্য সভা, সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। শ্রমিক দিবস উপলক্ষে সংবাদপত্রগুলি বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। রেডিও, টেলিভিশনে শ্রমিক দিবস সম্বন্ধে আলোচনা এবং কবিতা পাঠের ব্যবস্থা করা হয়।
শ্রমিকরা নানা রঙের ফেস্টুন এবং মাথায় রং বেরঙের কাপড় বেঁধে শোভাযাত্রা বের করেন। তারা অতীতের সংগ্রামের বিজয় উদযাপন করেন এই শোভাযাত্রা এবং মিছিলের মাধ্যমে।
শ্রমিক দিবসের প্রতিষ্ঠাতা কে?
শ্রমিক দিবসের প্রতিষ্ঠাতা হলেন পিটার জে. ম্যাকগুয়ের।
ভারতে প্রথম মে দিবস কোথায় পালিত হয়?
ভারতে প্রথম শ্রম দিবস বা মে দিবসটি ১৯২৩ সালে চেন্নাইয়ে (তৎকালীন মাদ্রাজ) মে দিবস উদযাপনের জন্য শ্রম কিষণ পার্টি কর্তৃক পালিত হয়েছিল।
শ্রমিক দিবস কত তারিখে পালন করা হয়?
পয়লা মে শ্রমিক দিবস পালন করা হয়। আমেরিকা এবং কানাডায় সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সোমবার শ্রমিক দিবস পালন করা হয়।
১লা মে শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হয় কেন?
শিকাগোতে ১৮৮৬ সালের হে মার্কেট শ্রমিক আন্দোলনের স্মরণে পয়লা মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসাবে বেছে নেওয়া হয়েছিল।
শ্রমিক দিবস সম্পর্কিত উল্লেখ্য উক্তিগুলি কি কি?
“কাজ লজ্জা নয়। আলস্যই লজ্জা।”
“দেশের প্রতি নিরলস অবদানের জন্য সমাজের সব কর্মীদের ধন্যবাদ।”
“যারা নিজেদের কাজ উপভোগ করেন, শুধুমাত্র তাঁরাই তা ঠিকমত করতে পারেন।”
“দরিদ্রের সাহায্য ছাড়া ধনীর পক্ষে ঐশ্বর্যের মালিক হওয়া সম্ভব নয়।”
শ্রমিক দিবস সম্পর্কিত উল্লেখ্য স্লোগান কি?
“আট ঘন্টার শ্রম, আট ঘন্টার ঘুম এবং আট ঘন্টার বিনোদন”।
২০২০ এবং ২০২১ সালে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের থিম কি ছিল?
২০২০ সালের থিম ছিল “কর্মক্ষেত্রে সুরক্ষা এবং নিরাপত্তা বজায় রাখা”।
২০২১ সালের থিম ছিল “মালিক শ্রমিক নির্বিশেষে মুক্তিবর্ষে গড়বো দেশ”।

শ্রমিক দিবস নিয়ে কিছু কথা বা গুরত্বপূর্ণ তথ্য
শ্রমিকশ্রেণী তথা শ্রমজীবী সকল মানুষদের চিন্তা চেতনায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে মে দিবস বা শ্রমিক দিবস। মালিকপক্ষের শোষণ এবং চক্রান্তের প্রতি তীব্র প্রতিবাদ হল বিশ্বজুড়ে শ্রমিকদের এক হওয়ার মন্ত্র। মে দিবস শ্রমিকশ্রেণীর সামনে আশার নতুন আলো নিয়ে এসেছে।
১৯৮৬ সালে ঐতিহাসিক মে দিবসের শতবর্ষ পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু বিশ্বের এক তৃতীয়াংশ শ্রমিক আজও মালিকপক্ষের কাছে শোষিত ও অবহেলিত হয়ে চলেছে । তারা আজ ও পুঁজিবাদী দাসত্ব থেকে মুক্তিলাভ করতে পারেনি। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি এখনো প্রবল।
শ্রমিকরা ন্যায্য অধিকার পাওয়ার জন্য এখনো লড়ে চলেছে। এই কারণে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শ্রমিক দিবসের গুরুত্ব অপরিসীম। মে দিবস আজ শুধু শ্রমিকদের কাজের ঘণ্টা বা ন্যায্য মজুরি পাওয়ার আন্দোলন নয়, আজ মে দিবস মেহনতি মানুষের সৌভ্রাতৃত্বের দিন।
শ্রমিক দিবস অনেক রক্তের বিনিময়ে পাওয়া দুর্লভ এক সম্পদ।
কঠিন পরিশ্রমের সঙ্গেই তৃপ্তি আসে। পৃথিবীতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসে এই কথাটা যেন আরও একবার নিজেদের মনে করিয়ে দিতে পারি সকলে।
এই শুভ কামনার সঙ্গে সকলকে জানাই মহান মে দিবস / আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবসের প্রীতি ও শুভেচ্ছা।